তিমির শ্বাস এত দীর্ঘ কেন?
এটা আমরা সকলে জানি, তিমি এবং ডলফিন মাছ নয়; তারা স্তন্যপায়ী, মানুষের মত!
পানির নিচে বাস করা সত্ত্বেও জলজ প্রাণি থেকে ব্যতিক্রম হওয়ার কিছু কারন আছে। তিমিরা তাদের শিশু ছেলেমেয়েদের প্রসব করে(মাছের মত ডিম দিয়ে নয় ) এবং তাদের দুধ খাওয়ায় । তারা ঊষ্ন রক্ত বিশিষ্ট। আসলে আমাদের এই প্রকৃতিতে কোনো ঘটনাই নিয়ম বহির্ভুত নয়।পৃথিবীতে অসংখ্য জলচর ও স্থলচর প্রাণি আছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ প্রানী অক্সিজেন ব্যবহার করে শ্বাসকার্য চালায়। অল্প কিছু নিন্ম শ্রেনীর ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন ছাড়াও বাঁচতে পারে। অক্সিজেন এরা সহ্য করতে পারে না।আবার পরিবেশ থেকে অক্সিজেন গ্রহনের জন্য উন্নত প্রাণিদের বিশেষ অঙ্গানু আছে। জলজ পরিবেশে এ অঙ্গানু হল গিলস বা ফুলকা ( মাছের কানকুয়ার নিচে থাকে) আর স্থলজ পরিবেশে এর নাম ফুসফুস।
গিলস পানি থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন ছেঁকে নেয়, আর ফুসফুস বাতাস থেকে অক্সিজেনকে সংশ্লেষন করে। যাইহোক, তিমি, ডলফিন এবং অন্যান্য মাছের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পার্থক্য হল এদের ফুলকা নেই, অথচ ফুসফুস আছে। এর অর্থ হল, এরা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ব্যবহার করে শ্বাস নিতে পারে না। তাহলে কিভাবে এরা শ্বাসকার্য চালায়? সহজ উত্তর, ফুসফুস কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশে আসলেই কেবল তারা শ্বাস নিতে পারবে। তাইতো প্রতিটি সময় যখন তারা বায়ু নিতে চায় তখন পানি পৃষ্ঠ ভেদ করে বায়ুর সমুদ্রে উঁকি দিতে হয়। বায়ুর সমুদ্রে উঁকি দেয় বলে এরা উভচর নয়। যেমন ব্যঙের কথাই ধরা যাক। এদের উভচর হওয়ার মূল কারন হল, জীবনকালের ব্যঙাচি দশায় এদের ফুলকা থাকে, আর পূর্নাঙ্গ প্রাপ্তি হলে তা ফুসফুসে পরিনত হয়। তাইতো পানির প্রতি ব্যঙের আকর্ষন স্বাভাবিক।
তিমির বিবর্তন
তিমি এবং ডলফিন, এবং কিছু অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী যেমন পিরফোইজ, ওয়ালরাস এবং সীলদের মতো, এরা ক্যাথেশিয়াস নামে একটি স্তন্যপায়ী গোষ্ঠীর অন্তর্গত।বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে লক্ষ লক্ষ বছর আগে, তিমিদের বিবর্তনবাদী পূর্বপুরুষরা পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াত, যেমন আমরা আজও করি।তবে, বছরের পর বছর ধরে, তারা ধীরে ধীরে সমুদ্রে চলে আসে, 'জল' জীবনধারা গ্রহণ করে এবং এখানে স্থায়ীভাবে সময় কাটানো শুরু করে। এই জন্যই সামুদ্রিক প্রানি (তিমি, ডলফিনের, ইত্যাদি) মাছ বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তাদের মাছের শ্রেণীবিন্যাসে বিন্যস্ত হওয়ার কোনো অধিকার নেই।
তিমি এবং ডলফিনের ফুলকা নেই
আমরা সম্ভবত হাই স্কুলে মাছের বিভিন্ন অঙ্গানু সম্পর্কে জেনেছিলাম। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল গিলস( Gills) বা ফুলকা। গিল হল মাছের এমন বিশেষ অঙ্গ আছে যার সাহায্যে মাছ জল থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন সংশ্লেষন করতে পারে এবং পানির নিচে শ্বাস কার্য চালায়। আমরা আগেই জেনেছি, ডলফিন ও তিমির ফুলকা নেই। এর বিপরীতে, ডলফিন এবং তিমির আমাদের মত ফুসফুসের একটি সেট আছে, যার অর্থ তারা পানির নিচে শ্বাস নিতে পারে না।এই জৈব প্রয়োজনের কারণে,এই প্রজাতিটি কিছুটা তাজা বাতাস পেতে ঘন ঘন পানি পৃষ্ঠে উঁকি মারতে দেখা যায়।যদিও ডলফিন সাধারণত কয়েক মিনিট পরই অক্সিজেন পাওয়ার জন্য পানি পৃষ্ঠে ভেদ করে মাথা তুলে। ডলফিনের নিঃশ্বাস ক্ষীন প্রকৃতির। তাহলে এরা ঘুমায় কিভাবে? ঘুমানোর সময়ও কি বায়ুর সমুদ্রে উঁকি মারে? পানিতে অভিজোজিত হতে ডলফিনের ভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্য আছে। ঘুমানোর সময় এদের মস্তিষ্কেরর অর্ধেক অংশ জেগে থাকে, আর বাকি অর্ধেক ঘুমায়। তাইতো এরা ঘুমের ঘরে ডুবে মরে না। কিন্তু তিমিরা নিশ্বাস নিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে। কি আশ্চর্য!
কিভাবে তিমি এত দীর্ঘ সময়ের জন্য পানির নিচে তাদের শ্বাস রাখতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি পয়েন্ট আকারে নিচে বর্ননা করা হল
১.দক্ষ শ্বাসযন্ত্র ব্যবস্থা
তিমির দৈহিক ব্যবস্থায় এমন কতগুলো বিশেষ উপাদান, অঙ্গ তথা ফ্যাক্টর আছে যেগুলো তিমির এই ব্যতিক্রমধর্মীতার বহিঃ প্রকাশ ঘটায়। শুরুতেই বলতে হয়, তিমির একটি খুব দক্ষ শ্বাসযন্ত্র ব্যবস্থা আছে, যা তাদের একটি একক শ্বাসের প্রভাব সর্বাধিক সময় ধরে রাখতে সাহায্য করে। মজার তথ্য হলো, আমরা মানুষেরা বিশ্রামের সময় মিনিটে ১২ থেকে ২০ বার শ্বাস ফেলি এবং প্রতি একক শ্বাসে মাত্র ৫% অক্সিজেন শোষণ করি। কিন্তু এর বিপরীতে তিমির বিশেষ দক্ষ শ্বাসযন্ত্র ব্যবস্থার জন্য ধন্যবাদই দিতে হয় কারন সে প্রতি শ্বাসে ৯০% অক্সিজেন শোষণ করে। তাইতো প্রতি শ্বাসে একটি তিমির মানুষের তুলনায় প্রচুর পরিমানে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়।
২.শক্তির সংরক্ষন
একটি শ্বাসকে পূর্ণ ভাবে কাজে লাগাতে তিমিরা কয়েকটি কাজ করে। প্রথমত, তার হৃদস্পন্দনকে কমিয়ে ফেলে। দ্বিতিয়ত, তার বিভিন্ন অঙ্গ যেমন : মস্তিষ্ক, পেশীসমুহ, হৃদযন্ত্র রক্ত প্রবাহের হার কমিয়ে দেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এসব করতে প্রানিটির রক্ত চাপের কোনো পরিবর্তন হয় না। এভাবে শক্তি সংরক্ষিত রেখে ধীরে ধীরে বন্টন করে।
২.মায়োগ্লোবিন
তিমিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মাইোগ্লোবিন, অধিকাংশ স্তন্যপায়ীর পেশীগুলির মধ্যে উপস্থিত একটি প্রোটিন।
মায়োগ্লোবিনের প্রাথমিক কাজ অক্সিজেন অণুর সাথে বন্ধন তৈরী করা, বা আরো সহজভাবে, অতিরিক্ত অক্সিজেন সঞ্চয় করা। অতএব, যখন আপনি অল্প সময়ের জন্য আপনার শ্বাস রাখেন,তখন মায়োগ্লোবিন যা আপনার শরীরের অক্সিজেন প্রদান করে।যেহেতু জলজ স্তন্যপায়ী বেশিরভাগ সময় পানির নিচে ব্যয় করে, তাদের পেশীগুলি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মতো স্থল-ভিত্তিক স্তন্যপায়ীদের চেয়ে বেশি মায়োগ্লোবিন থাকে।এমনকি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের মধ্যে, তিমির মায়োগ্লোবিনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তিমির পেশীগুলিতে ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট মায়োগ্লোবিন প্রোটিন রয়েছে। এই বিশেষ বৈশিষ্টের কারনে তিমি অন্যান্য স্তন্যপায়ীর তুলনায় তাদের পেশীতে আরো বেশী মায়োগ্লবিন প্যাকিংয়ে সহায়তা পায়। মাইগ্লোবিন প্রোটিন সাধারণত একসঙ্গে জোট বেঁধে থাকে, কিন্তু যখন তারা একই চার্জ চার্জিত থাকে, তখন তারা একে অপরকে বিকর্ষণ করে (যেমন চুম্বকের একই মেরু একে অপরকে বিকর্ষণ করে) এবং এই প্রোটিন অনুগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এই বৈশিষ্ট্যই অন্য স্তন্যপায়ীদের তুলনায় অনেক দূরে পর্যন্ত 'একটি তিমিকে শ্বাস' রাখতে সক্ষম করে।
Video credit: Scishow
No comments