হেলিওস্ফিয়ারঃঃ আমাদের সৌরজগতের ছাদ
আমাদের ঘর বাড়ির ছাদ হোক না সেটা খড়, টিন কিংবা কনক্রিটের, তা আমাদের ঝড়,বৃষ্টি, রোদ, বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। তেমনি, আমাদের সৌরজগতের বাইরে চারিদিকে বিশালাকার একটি অংশ আছে যা আমাদের মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করছে। আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কথাই ধরা যাক। এখানে পাঁচটি আবরণ আছে। এর মধ্যে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে আছে সবার পরিচিত ওজোন স্তর। যা আমাদেরকে ক্ষতিকর আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করছে। এই স্তরগুলো পৃথিবীর জন্য ছাদের ভুমিকা পালন করে। তো সৌরজগতের এই ছাদের নাম হেলিওস্ফিয়ার।
উৎসঃ www.bishwo.com |
সূর্য আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় সাতাইশ হাজার আলোক বর্ষ দুরে ওরাইওন নামক বাহুতে রয়েছে। সূর্য ২২৫-২৩০ মিলিয়ন বছরে গ্যালাক্সি কে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসে। সূর্য প্রায় ২৫১ কিলোমিটার / সেকেন্ড বেগে সামনে এগিয়ে চলছে।
সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত চার্জিত কণা তথা প্লাজমা সৌরজগতের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।এই কণাসমূহ সুপারসনিক বেগে ( শব্দের চেয়ে বেশী বেগে) ছড়িয়ে পড়ছে। আলট্রা ভাওলেট রশ্মিতে দেখলে বোঝা যায়, কত বেশী, কত দ্রুত এই কণা সমূহ সৌর জগতে ছড়িয়ে পড়ছে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ধরুন আকাশ হতে প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে। আর একই সময় একটি বড় বস্তু আকাশে স্থির হয়ে আছে। তাহলে একজন দর্শক যদি ঐ বস্তুটার উপর বৃষ্টির পতন দেখে সে কেমন দেখবে? ঠিক তেমনি বৃষ্টির চেয়ে আরও দ্রুত, ঘনত্বপূর্ন চার্জিত কণা পৃথিবীর উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এর প্রভাব থেকে পৃথিবীর শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর জীবকুলকে রক্ষা করছে। এই ঘটনাকে বা হয় সৌর বায়ু প্রবাহ।বলতে পারেন , সূর্যে আবার বায়ু আছে নাকি? বায়ু বলতে আমরা শুধু বাতাস তথা অক্সিজেনকেই মনে করি। কিন্তু বায়ু হল যে কোন গ্যাস বা চার্জিত কণার প্রবাহ।
চিত্রঃ হেলিওস্ফিয়ার ও এর বিভিন্ন অংশ । (উৎসঃ নাসা)
সুতরাং সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ২৫১ কিলোমিটার বেগে ছুটতে ছুটতে ৪০০-৮০০ কিলোমিটার / সেকেন্ড বেগে চার্জিত সৌর বায়ু সৌর জগতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই তথ্য দিয়ে একটি কল্পনার ছবি হৃদয়ে এঁকে ফেলেন। পরবর্তীতে বুঝতে সহজ হবে। এক কথায় সূর্য সৌর বায়ু স্প্রে করতে করতে ২৫১ কিলোমিটার / সেকেন্ড বেগে এগিয়ে চলছে।
আবার মহাশূন্যে সূর্যের মত আরও অনেক নক্ষত্র আছে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই আছে কয়েক বিলিয়ন কোটি নক্ষত্র। বিভিন্ন নক্ষত্রের মধ্যকার পরিবেশ তথা মাধ্যমকে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম (interstellar medium) বলা হয়। এই নক্ষত্রসমূহও হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের প্লাজমা দিয়ে গঠিত। তারাও বিভিন্ন কণার বিকিরণ, প্রবাহ, মহাজাগতিক রশ্মি আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যেমে প্রচন্ড বেগে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের প্রবাহ আমাদের সৌরজগতের উপর চাপ প্রয়োগ করে প্রবেশের চেষ্টা চালায়।
কিন্তু সূর্যের সৌর বায়ু প্রবাহ দ্রুত বেগে প্রবাহিত হয়ে এই আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের চাপকে প্রতিহত করে। এই ঘটনা সৌর জগতের চারপাশেই ঘটে থাকে। সৌর বায়ু প্রবাহ নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের প্রবাহকে বাধা দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে সৌর বায়ু প্রবাহের বেগ আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের প্রবাহের ক্রিয়ায় ধীরে ধীরে কমতে কমতে শূন্য হয়ে যায়। তাহলে চিন্তা করে দেখেন, সূর্য নির্দিষ্ট বেগে সামনে ছুটতে ছুটতে নির্দিষ্ট বেগে সৌর বায়ু নিক্ষিপ্ত করছে এবং একই সাথে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যেমে থেকে চার্জিত কনা সূর্যের দিকে ছুটে আসছে।তাহলে কেমন পরিবেশ তৈরী হবে , ভাবতে পারেন?
এটা স্রোতের বিপরীতে একটি নৌকার গতির মত নয় কি? কিংবা স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলা সাবমেরিনের মত নয় কি?যেখানে, সাবমেরিনের উপর -নিচে, ডান -বাম সব দিক দিয়ে পানি সরে যাচ্ছে। এই ঘটনা গ্যাসীয় মাধ্যমে ঘটলে চিত্র টা কেমন হবে? তখন সূর্যের চারপাশে বিশালাকার বুদবুদের মত একটি পরিবেশ তৈরী হবে কিনা? ঠিক দেখতে ডিমাকৃতির লেজ যুক্ত বুদবুদের মতো । এটিই মুলত হেলিওস্ফিয়ার নামে পরিচিত। বলতে পারেন, হেলিওস্ফিয়ারের আকৃতি বুদবুদের মতো গোলাকারই হবে। কিন্তু এর আকৃতি সুষম গোলাকার নয়। আপনারা চিত্রটি লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন। হেলিওস্ফিয়ার বিভিন্ন প্রসারিত অংশ নিয়ে গঠিত। আমরা এই অঞ্চলসমূহ নিয়ে আলোচনা করব। ২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নাসা ঘোষণা করে যে, ২৫ আগষ্ট ২০১২ সালে ভয়েজার-১ হেলিওস্ফিয়ার অঞ্চলকে পাড়ি দিয়েছে, যেখানে প্লাজমার ঘনত্ব সৌরজগত থেকে ৪০ গুন বেশী।
সূর্যের সর্ববহিঃস্থস্তর সৌর মুকুট তথা করোনা থেকে সৌর প্রবাহের কণাসমূহ ৩০০-৮০০ কিলোমিটার / সেকেন্ডে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়। পরবর্তীতে এই কনা সমূহ আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যেমে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলে, ধীরে ধীরে বেগ হারিয়ে ফেলে। সৌরজগতের বাইরে যে বিন্দুতে বা অঞ্চলে সৌর প্রবাহের বেগ শব্দের বেগের চেয়ে ধীর হয়, সেই অঞ্চলকে বলা হয় টার্মিনেশন শক বা চুড়ান্ত ধাক্কা। এই অঞ্চলে সৌর বায়ু প্রবাহের বেগ সুপারসনিক থেকে সাবসনিক( শব্দের চেয়ে কম বেগ) হয়। পরবর্তীতে এই সৌর প্রবাহের বেগ ধীরে ধীরে আরও কমতে থাকে। সর্বশেষ হেলিওপাউস অঞ্চলে সৌর প্রবাহের চাপ ও আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের চাপ সাম্যাবস্থা লাভ করে। টার্মিনেশন শক অঞ্চলটি ২০০৪ সালে ভয়েজার -১ এবং ২০০৭ সালে ভয়েজার -২ অনুপ্রস্থ ভাবে পাড়ি দিয়েছিলো।
হেলিওস্ফিয়ারের গঠন
টার্মিনেশন শক
যে বিন্দুতে সৌর বায়ু স্থানীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের সাথে ক্রিয়া করা শুরু করে এবং এর গতি কমে যায়, সেই অঞ্চলকে বলা হয় টার্মিনেশন শক।এই অঞ্চলে সৌর বায়ু প্রবাহের বেগ সুপারসনিক থেকে সাবসনিক হয়।
হেলিওশিথ
হেলিওপাউস ও টার্মিনেশন শকের মধ্যে এই অঞ্চল টি অবস্থিত। এখানে সৌর বায়ুর বেগ অনেক কমে যায় ও সৌর বায়ু সংকুচিত হয়। কারন আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের সাথে ক্রিয়া করে বলে।
হেলিওপাউস
সৌর বায়ু যে অঞ্চলে গিয়ে নাক্ষত্রিক বায়ুকে বাধা দিতে পারে না বা বেগ শূন্য হয়ে যায়, সেই অঞ্চলটিই হেলিওপাউস নামে পরিচিত।
হেলিওটেইল
যখন হেলিওস্ফিয়ার আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন নদীতে চলমান নৌকার পানি লেজের মতো তৈরী করে অগ্রসর হয়, এর নাম হেলিওটেইল।
No comments