মহাবিশ্বের অধিকাংশ পদার্থের দশাঃ প্লাজমা কী?
আমাদের ভূপৃষ্ঠের দৃশ্যমান পদার্থগুলো কঠিন অথবা তরল। তাই আমাদের মনে হতে পারে, এই মহাবিশ্বের অধিকাংশ পদার্থই কঠিন অথবা তরল। কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণরুপে ভুল। আমাদের মহাবিশ্বে আছে অসংখ্য নক্ষত্র, সুপারনোভা, গ্যালাক্সি। এসব কিছুর গাঠনিক পদার্থ হল প্লাজমা। কঠিন, তরল ও গ্যাসের মত প্লাজমাও পদার্থের একটি অবস্থা। একে পদার্থের চতূর্থ অবস্থাও বলা হয়। আমরা আজকে জানব, মহাবিশ্বের অধিকাংশ পদার্থের দশা- প্লাজমা সম্পর্কে।
প্লাজমা কি?
আমরা যদি বরফকে তাপ দিই তবে পানি পাব, আর পানিকে তাপ দিলে বাষ্প পাব। এখন বাষ্পকে একটি আবদ্ধ পাত্রে রেখে প্রচণ্ড তাপ দিলে কি ঘটবে? প্রথমত, পানি গঠনকারী মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদা হয়ে যাবে। এখানেই শেষ নয়, হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ও ইলেক্ট্রন পরস্পর আলাদা হয়ে মুক্তভাবে বিচরন করবে অথ্যাৎ নিউক্লিয়াস ও ইলেক্ট্রনের মধ্যে কোনোই আকর্ষণ বল থাকবে না। এই অবস্থার নাম প্লাজমা। প্লাজমার একটি ফেজ ডায়াগ্রাম নিম্নে দেখানো হলো।( এনথালপি একটি সিস্টেমের মোট শক্তি) 
চিত্র -১: পদার্থের বিভিন্ন অবস্থার পরস্পর পরিবর্তন
প্লাজমা কঠিন, তরল ও গ্যাসের মতো পরমাণুর একটি মিশ্রণ নয়। প্লাজমা হল ইলেকট্রন এবং আয়নের মিশ্রন ।
সূর্যের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং সামান্য পরিমাণ অন্যান্য ভারী মৌল যে ভৌত অবস্থায় বিরাজ করে তার নামও প্লাজমা।আর যেখানে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে থাকে। প্লাজমার শক্তি গ্যাসীয় অবস্থার চাইতে অনেক বেশী।
নিচের চিত্রটি কঠিন বস্তুর, তরল, গ্যাস এবং প্লাজমার তুলনা করা হয়েছে। চিত্র টি দেখলে প্লাজমা বিষয়টা বুঝা সহজ হবে। সুতরাং কঠিন বস্তু, তরল, গ্যাসের মত প্লাজমাও পদার্থের একটি অবস্থা। একে পদার্থের চতুর্থ অবস্থাও বলা হয়।
চিত্র -২:পদার্থের কঠিন, তরল, গ্যাস এবং প্লাজমা অবস্থার তুলনা
একটি পরমানুর এক বা একাধিক ইলেক্ট্রন স্থির তড়িৎ বন্ধন বলকে অতিক্রম করার মত যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে পারলে ঐ ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াস থেকে বিচ্ছিন্ন হয় ।এই আয়নিত অবস্থার ফলাফল হল প্লাজমা। আয়নিত হওয়ার পর সিস্টেমের শক্তি কমে গেলে ইলেকট্রনের ঋণাত্মক চার্জ নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জ প্রোটনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং আয়ন, ইলেক্ট্রন পুনর্মিলিত হয়ে তড়িৎনিরপেক্ষ পরমাণুতে পরিণত হয়। একটি পরমানু আংশিকভাবে আয়নিত (কিছু ইলেকট্রন হারিয়ে) বা সম্পূর্ণ রূপে আয়নিত (সব ইলেকট্রন হারিয়ে) হতে পারে। আর এটা নির্ভর করবে, পরমানুর ইলেক্ট্রনের অর্জিত শক্তির উপর। নিচের চিত্রে উদাহরণ হিসেবে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের আংশিকভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে আয়নিত পরমাণু মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে।
চিত্র -৩: হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের আংশিকভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে আয়নিত পরমাণু
হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মধ্যে কোনটির সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হওয়া সহজ? নিশ্চয়ই, হাইড্রোজেন শুধুমাত্র সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হতে পারে। কিন্তু হিলিয়াম আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হতে পারে, কারন হিলিয়ামের একাধিক ইলেক্ট্রন রয়েছে।বৃহত্তর পরমাণুসমূহ এক, দুই, তিন বা আরো ইলেকট্রন হারিয়ে অধিকভাবে আংশিক আয়নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্লাজমায় আয়নিত নিউক্লিয়াস ও ইলেক্ট্রনের সংখ্যা সমান। একটি প্লাজমা মিশ্রনে প্রোটন ও মুক্ত ইলেক্ট্রনের সংখ্যা সমান থাকে। যেকোনো তড়িৎ নিরপেক্ষ পরমানু আয়নিত হয়ে প্লাজমায় পরিনত হতে পারে। তাইতো শুধু ইলেকট্রন বা অন্য কণার বিম প্লাজমা নয়। প্রত্যেক পদার্থের মত প্লাজমা কিছু সমষ্টিগত আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। যেমন প্লাজমার বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। অধিকাংশ (কিন্তু সব না) গবেষক,একটি মোমবাতি শিখাকে প্লাজমা হিসেবে বিবেচনা করেন না। কারন এতে খুবই দুর্বল আয়নিত গ্যাস প্লাজমার সমষ্টিগত কিছু বিশেষ আচরণ প্রদর্শন করে না।
আরেকটি ধর্ম হল, প্লাজমায় উচ্চ তাপমাত্রার গতিশীল ইলেক্ট্রন বহির্মুখী চাপ ও চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরী করে। আবার প্লাজমা বৈদ্যুতিকভাবে পরিবাহী কারণ তারা মুক্ত সঞ্চরনশীল ইলেকট্রন ধারন করে বিভব পার্থক্য তৈরী করে নির্দিষ্ট দিকে তড়িৎ পরিবহন করে।
No comments