মহাকাশযানের পৃথিবীতে সংকেত পাঠানোর পদ্ধতি
রাতের আকাশে তাকালে অবাক বিস্বয়ে অস্থির চিত্ত ভাবে মিটমিট করা বিন্দুগুলিকে নিয়ে। কোনোটা বড়, কোনটা অস্পষ্ট। আবার কোনোটা মহাকাশের ছাউনি বেয়ে আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন দিকে। আসলে এগুলো কি? কেনই বা এখানে? কেনই বা আমাদের ভাবিয়ে তোলে? এসব প্রতিটি মানুষের মনের সাধারন প্রশ্ন। তাইতো মানব সভ্যতার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ আকাশকে নিয়ে ভেবেছে।
আকাশের তারকার সুনিপুন, স্বন্দিতগতি হিসেব করে অন্ধকারে পথ চলেছে। তৈরী করছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ও সাহিত্যকর্ম। যুগে যুগে তাদের এহেন গবেষনার প্রমান ইতিহাসে পাওয়া যায়।এসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে মহাশূন্য মানুষ পাঠিয়েছে অসংখ্য মহাকাশযান বা স্পেস প্রোব, কৃত্তিম উপগ্রহ।
রাতের আকাশে তাকালে কিছু সময় পরপর গতিশীল কিছু আলোকিত বিন্দু দেখা যায়।এগুলো আসলে কৃত্তিম উপগ্রহ তথা স্যাটেলাইট। মানুষকে মহাকাশযান পাঠানোর পূর্বে কার্যকর যোগাযোগ ব্যাবস্থা তৈরীর জন্য তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গকে রপ্ত করার কৌশল শিখতে হয়েছে।কারন,কোন মহাকাশ মিশনের সবচেয়ে মৌলিক প্রয়োজনীয়তা হল কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা। মহাকাশচারীদের মিশনের সকল ধরনের প্রয়োজনীয়তা, রণকৌশল এবং সম্ভাব্য পরিমাপগুলি সম্পন্ন করার জন্য সর্বদা স্থল ইউনিটগুলির সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হওয়া একান্ত প্রয়োজন।কৃত্রিম উপগ্রহ এবং স্থান অনুসন্ধানের জন্য অজ্ঞাত বস্তুগুলিকে তথ্য বিনিময় করতে স্থায়ীভাবে গ্রাউন্ড বেস স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করতে হয়।সুতরাং, কিভাবে এই মহাকাশযানগুলি , যা শত শত, হাজার হাজার, অথবা এমনকি লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার( যেমন- ভয়েজার ১ও২) দূরে থেকে পৃথিবীর লোকেদের সাথে যোগাযোগ করে?
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ
মহাশূন্যে যে কোন ধরনের যোগাযোগের প্রতিটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ দ্বারা সঞ্চালিত হয়।আমরা সব সময়ে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত এবং এর সাগরে ডুবে আছি।আমরা নিম্নলিখিত চিত্রের সঙ্গে পরিচিত, যা তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালীর বিভিন্ন পর্যায় প্রকাশ করে।
চিত্রঃ তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের বর্ণালী (Photo Credit: Designua / Shutterstock)
আমাদের চোখ দৃশ্যমান আলো দিয়ে দেখতে পায়, যা একটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। রেডিও তরঙ্গও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের একটি প্রকার।
রেডিও তরঙ্গ উপগ্রহ, স্থান অনুসন্ধান বা অন্য কোনও মনুষ্যসৃষ্ট বস্তুর সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।যাই হোক, গত পঞ্চাশ বছরে যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নাটকীয় অগ্রগতির জন্য লেজার কমিউনিকেশন্স রিলে ডেমনস্ট্রেশন মিশন ( LCRD) ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তথ্য প্রেরণ এবং তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যমে রেডিও তরঙ্গের দক্ষতা যোগাযোগের এই নতুন পদ্ধতি দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।রেডিও তরঙ্গের পরিবর্তে লেজার ব্যবহার করলে আজকের অপারেটিং সিস্টেমের সেরা আরএফ রেডিওগুলির তুলনায় 10 থেকে 100 গুণ বেশি দ্রুত গতিতে ডাটা এনকোড করে প্রেরণ করা যায়।যোগাযোগের জন্য লেজার ব্যবহার করার অন্য সুবিধা হল, যেহেতু এটি রেডিও তরঙ্গের চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য ধারণ করতে পারে, তাই যখন মহাশূন্যে ভ্রমণ করে থাকে তখন এটি রেডিও তরঙ্গের তুলনায় কম শক্তি অপচয় করে।
কিভাবে মহাকাশযান রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করে?
প্রতিটি স্যাটেলাইট বা স্পেস প্রোবের একটি ট্রান্সিসাইভার (রেডিও)দিয়ে সজ্জিত করা হয়। এখানে অবস্থিত একটি ডিশ অ্যান্টেনা যা রেডিও সিগন্যাল নির্গত করে।এই সংকেতগুলি পৃথিবীর অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সংবেদনশীল এন্টেনা দ্বারা সনাক্ত করা হয় এবং সংকেতগুলিকে উচ্চ প্রযুক্তির কম্পিউটারে নিয়ে ব্যাপকভাবে হিসাব নিকাশ করে সংকেতগুলি থেকে দরকারী তথ্য বের করে আনা হয়।
আমারা একটু বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করি।মহাকাশ গবেষণা বোর্ডে উচ্চ-কারিগরি ব্যবস্থা রয়েছে যা তাদের মিশন বজায় রাখতে সক্ষম করে এবং পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রেরণ করতে সাহায্য করে।
যখন একটি স্পেস প্রোব, যেমন ভয়েজার -১ একটি গ্রহের বা গ্যালাক্সির ছবি তোলে, তখন এই ছবিটি একটি কম্পিউটারের সাহায্যে বাইনারী কোডে পরিনত হয়। কম্পিউটারটি এই বাইনারী কোডকে ট্রান্সপন্ডারে রিলেই করে, যা এই কোডটিকে রেডিও তরঙ্গে 'স্থানান্তরিত করে। এরপরে কম্পিউটার রেডিও তরঙ্গটিকে স্পেসের মধ্য দিয়ে প্রেরণ করে। প্রেরিত এই তরঙ্গগুলি পৃথিবীতে পৌছাতে দীর্ঘ দূরত্বের পথ পাড়ি দেয়। তাই পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ দীর্ঘ সময় গ্রহণ করে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে ভয়েজার -১ কর্তৃক একটি পাঠানো সংকেত পৃথিবীতে পৌছাতে ১৮ ঘন্টা সময় নেয়।
পৃথিবীতে গভীর মহাকাশ নেটওয়ার্ক (deep space network) সংক্ষেপে DSN নামে অনেক শক্তিশালী রেডিও অ্যান্টেনা আছে যা মহাশূন্য থেকে পাঠানো এই সংকেতগুলিকে রিসিভ করে। DSN তিনটি বিশেষ জায়গা যেমন ১.গোল্ডস্টোন, ক্যালিফর্নিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত ২. মাদ্রিদ, স্পেনের কাছাকাছি অবস্থিত; এবং ৩.কানবাররা, কানাডার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত। যা পৃথিবীর 120 ডিগ্রি লম্বা রেখায় অবস্থান করে এবং পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান অবস্থায় তথ্য আদান প্রদানের প্রবাহ ধ্রুবক রাখতে সহায়তা করে।
সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম হিসাবে, এটি সকল আন্তঃগ্রহীয় মিশন এবং পৃথিবীর কক্ষপথের কৃত্তিম উপগ্রহগুলোকে সহযেগিতা করে আসছে। স্পেস প্রোব কর্তৃক স্থানান্তরিত বাইনারী সংকেত (যা প্রোবটির বর্তমান অবস্থার প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক তথ্য, ছবি এবং অডিও ফাইল সহ)DSN এর অ্যান্টেনা সনাক্ত করে কম্পিউটারে রিলে করে, এবং এই সংকেতটিকে ডিকোড করে সংবেদনশীল তথ্যে পরিবর্তন করে।
তথ্যের এই আদানপ্রদান আমাদের জীবনের বাস্তবিক একটি উদাহারন দিয়ে বুঝানো যাক ।যখন আমরা একটি সেলফি ফেইসবুকে পোস্ট করি, ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত আমাদের সকল বন্ধুদের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে তা পৌঁছে যায়।কারণ আমাদের স্মার্টফোনটি রেডিও তরঙ্গের ট্রান্সমিটার হিসাবে কাজ করে। এটি আমাদের সেলফিকে একটি স্বতন্ত্র বৈদ্যুতিক সংকেত হিসেবে প্রেরণ করে রেডিও তরঙ্গে ছেড়ে দেয়।তখন সেলফি রেডিও তরঙ্গের বিশাল সমুদ্রে ভাসতে থাকে এবং পরবর্তীতে বন্ধুর স্মার্টফোনে অবস্থিত অ্যান্টেনা দ্বারা এই সংকেতটি গৃহীত হয়। এরপর বন্ধু আপনার সেলফি দেখতে পায়।তখনি খুশি হয়ে লাইক দেয়। একই ঘটনা ঘটে (শুধুমাত্র বিপরীত দিকে) যখন আপনার বন্ধু একটি ছবি পোস্ট করে এবং আপনি স্মার্টফোনে এটি দেখতে পান। নাম থেকেই বুঝতে পারছি, DSN মহাকাশের দূরবর্তী বস্তু থেকে আসা সংকেত সনাক্তকরণের জন্য সাধারণত ব্যবহৃত হয়।তবে,মহাকাশের তেমন গভীরে নয় বলে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সাথে যোগাযোগের জন্য সাধারনত কম শক্তিশালী এন্টেনা ব্যবহার করা হয়। আবার লেজার রশ্মি ব্যবহার করে অনুসন্ধান এবং কৃত্রিম উপগ্রহগুলির সাথে যোগাযোগের মৌলিক প্রক্রিয়া মূলত একই।যদি এই সহজে যোগাযোগের অবিশ্বাস্য কার্যকর কৌশল না তৈরী হত, তবে আমরা মহাকাশের বিশালতা অন্বেষণ করতে পারতাম না এবং মহাকাশে মহাকাশচারী পাঠানো আরো অনেক কঠিন হত।
Video credit: Primal Space
No comments