চাঁদ বা সূর্যকে দিগন্তে বড় দেখায় কেন?


দিগন্তে থাকাকালীন সময়ে চাঁদ বা সূর্যকে বড় দেখায়, কিন্তু মাথার  উপরে এদেরকে তুলনামূলক ছোট দেখায়। কিন্তু সূর্য ও চাঁদের আকার সর্বদা একই, সে দিগন্তে বা মাথার উপর যেখানেই থাকুক। কখনও কি ভেবেছি, সূর্য ও চাঁদকে দিগন্তে কেন বড় দেখায়??
আমরা আজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব,যে প্রশ্নের উত্তর কৌতুহলী  মানুষ খুঁজেছে বহুকাল ধরেই , দিয়েছে অনেক ব্যাখ্যা, দাড় করিয়াছে  অনেক প্রকল্প (hypothesis), সৃষ্টি করেছে বিতর্কের। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, সূর্য বা চাঁদ দিগন্তে থাকাকালীন এদের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দ্বারা বেশী বিবর্ধিত হয় বলেই, তাদের  বড় দেখায়। সমকালীন সময়ে এরিস্টটলের এই উত্তর অনেক টেকনিক্যাল। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা বলেন, বায়ুমণ্ডল দ্বারা শুধুমাত্র আলোর বর্ণের পরিবর্তন ঘটে, বিবর্ধন নয়। যেমন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে থেকে সূর্যকে উজ্জ্বল সাদা দেখায়, কিন্তু পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে হলুদ দেখায়। পরবর্তীতে খৃষ্টীয় ১১ শতাব্দীতে  আরব বিজ্ঞানী ইবনে আল হাইসাম একটি বিশ্বাসযোগ্য তত্ব দেন, তার মতে এই ঘটনাটি স্রেফ দৃষ্টি বিভ্রম মাত্র। আধুনিক সময়ের বিজ্ঞানীরা এই ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখানে সর্বসম্মত ব্যাখ্যাগুলি উপস্থাপন করছি।

১. আকাশে অবস্থিত বস্তুর ( চাঁদ, সূর্য, তারা) অলৌকিকভাবে আকার পরিবর্তন  আর কিছুই নয় একটি আলোক বিভ্রম মাত্র। মেরিও পন্জ্ব (Mario Ponzo) নামক এক বিজ্ঞানী ১৯১৩ সালে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এই আলোক বিভ্রমের ব্যাখ্যা দেন। তার নাম অনুসারে এর নাম Ponzo illusion. আমরা চিত্র- ক এ সমান দৈর্ঘের দুটি অনুভূমিক রেখা দেখতে পাচ্ছি। পরবর্তীতে দুটি সমকেন্দ্রিক রেখা দ্বারা চিত্রানুযায়ী আবদ্ধ করলে কি দেখা যাচ্ছে?
   চিত্র : Ponzo illusion (@ Scienceabc.com)
দুটি রেখাকে নিশ্চয়ই সমান দেখা যাচ্ছে না। কেন? কেন ভুল দেখছি আমরা?  কারন চিত্র -খ এ উপরে অবস্থিত অনুভূমিক রেখাটির পাশে সমকেন্দ্রিক তথা দৃষ্টি রেখা দুটি সংকীর্ন হয়েছে। যেখানে দৃষ্টি রেখাগুলি সংকীর্ন আর যেথায় প্রশস্ত, এই দুই স্থানে অবস্থিত একই আকারের বস্তুকে ভিন্ন দেখায়। দিগন্তে আমাদের দৃষ্টি রেখাগুলি  সমকেন্দ্রিক রেখাগুলোর মত সংকীর্ন হয়ে যায়, ফলে আমরা দিগন্তে চাঁদ বা সূর্যকে বড় দেখি। নিচের চিত্রটি লক্ষ করি
চিত্র : চাঁদের Ponzo illusion( উৎসঃ ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মাইন)
নিচের চিত্রটি আলোক বিভ্রমের আরো ব্যাপকতা নির্দেশ করে। চিত্রে প্রদর্শিত তিন জনের উচ্চতা সমান। দৃষ্টিরেখাগুলির সংকীর্নতা এবং প্রশস্ততার জন্য এদেরকে যথাক্রমে ছোট ও বড় দেখাচ্ছে।

২. যখন সূর্য ও চাঁদ দিগন্তের কাছাকাছি থাকে, তখন চারপাশে অবস্থিত বাড়ি, গাছ,বহুতল ভবন দেখে তুলনা করতে পারি যে, সূর্য বা চাঁদটি বড়। কিন্তু যখন এরা মাথার উপরে থাকে তখন তুলনীয় বস্তু এক বিশাল আকাশ ছাড়া কিছুই থাকে না। তাইতো বিশাল আকাশের মাঝে একে তুলনামূলক ছোট দেখায়। যখন একটি বস্তুকে কতগুলো বড় বস্তুর সাথে তুলনা কর করা হয়, তখন বস্তুটিকে ছোট দেখায়। একই বস্তুকে যদি কতগুলো ছোট বস্তুর সাথে তুলনা করা হয়, তখন বস্তুটিকে বড় দেখায়। এই বিভ্রমকে  Ebbinghaus illusion বলা হয়। চিত্রে প্রদর্শিত বৃত্ত দুটির আকার যদিও একই কিন্তু illusion এর কারনে ভিন্ন দেখাচ্ছে।


 চিত্র: Ebbinghaus illusion( উৎসঃ প্রিভেন্টিভ মিজার ডট কম)
৩.আমাদের মস্তিষ্কের ধারনা অনূযায়ী, দিগন্তের আকাশ মাথার উপরে অবস্থিত আকাশ থেকে বেশী দূরে। কারন আমাদের মস্তিষ্ক আকাশকে চ্যাপটা গম্বুজের মত মনে করে, যদিও আকাশ গোলীয় গম্বুজের মত। এরকমটি ভাবার কারনে মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয় যে, দিগন্ত দূরে বলে দিগন্তের সূর্য বড় এবং মাথার উপরে অবস্থিত আকাশ কাছে বলে এখানে অবস্থিত সূর্য ছোট হবে। কতই না অদ্ভুত আমাদের মস্তিষ্ক

  চিত্র : চাঁদের আপাত প্রকৃত গতি পথ

আমাদের মস্তিষ্কের এই বিভ্রমের গভীরতা নিয়ে একটু ধারনা দিতে চাই।  ধরুন একজন দর্শক দিগন্তের সূর্যকে দেখতেছে, অপর একজন দর্শক সোজা মাথার উপরে অবস্থিত সূর্য কে দেখতেছে। তাহলে এই দুই দর্শকের মধ্যবর্তী দুরত্ব পৃথিবীর ব্যাসার্ধের সমান। সূতরাং মাথার উপরে অবস্থানকারী সূর্য দিগন্তে অবস্থানকারী সূর্য অপেক্ষা ৬৪০০ কিলোমিটার কাছে থাকে। অথচ, দিগন্তের সূর্য দর্শক থেকে দূরে থাকা সত্তেও একে আমরা বড় দেখতেছি। কতই না বিভ্রমতা আমাদের মস্তিষ্কের ভাবনা ও চোখের দৃষ্টিতে।
উৎসঃ http://www.slate.com/ 



পরিশেষে একটি কথা বলতেই হয় – আমাদের মস্তিষ্ক এমন একটি মেশিন যা একটি দৃশ্যকে অগনিত উপায়ে পর্যবেক্ষন, ও বিশ্লেষণ করে থাকে এবং কখনও বিভ্রমতা তৈরী করে আমাদের জ্ঞানের দৃষ্টি খুলে দেয়। মস্তিষ্ক বিভ্রম তৈরী করে দিগন্তের চাঁদকে অসাধারন সৌন্দর্যমন্ডিত বিবর্ধনে প্রদর্শিত করে বলে আমরা তাকে কোনো অভিযোগ দেই না।



  Video credit: TED-Eda

No comments

Theme images by JacobH. Powered by Blogger.