সূর্যের ব্যবচ্ছেদঃঃ কেন্দ্রীয় অঞ্চল বা মূল অংশ
আমাদের সৌর জগতের সকল শক্তির উৎস সূর্য। কারন সূর্য থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে আলো ও তাপ।আর এই আলো ও তাপ শক্তি ব্যবহার করে বেঁচে আছে এই পৃথিবীর সকল প্রাণ। তাইতো আমরা সূর্য কে কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে মামা বলে ডাকি। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের সূচনার পিছনে রয়েছে সূর্যি মামার বিশাল হাত। আবার সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে গাছের পাতায় পাতায় যে রান্না-বান্না চলছে তারও সূচনা হয়েছে এই মামার হাত ধরেই। অসাধারণ পরোপকারী এক মামা! কামনা করি, জনম জনম মামার এই পরোপকার বজায় থাকুক।
কিন্তু মামা কি পারবে অনন্তকাল ধরে মামাগীরি বজায় রাখতে?কারন সূর্যি মামার ভিতরে লুকিয়ে আছে আরেক মামা। আরেক মামার কারণেই সূর্যি মামার এত বাহাদুরি। আরেক মামাই সূর্যি মামার ভিতরে আলো, তাপ ও শক্তি তৈরী করছে।তাহলে আর রাখঢাক না করে বলি সেই মামার নাম। সেই মামা হল সূর্যের কোর বা মূল অংশ বা কেন্দ্রীয় অঞ্চল।
চিত্রঃ সূর্যের কেন্দ্র বা কোর
একে সূর্যের মাইটোকনড্রিয়া বললেও ভুল হবে না। কারন সূর্য কে যদি একটি কোষ হিসেবে বিবেচনা করি,তবে সূর্যের কোরই হচ্ছে এর সকল শক্তির উৎপাদনশীল কারখানা।কোরেই ঘটছে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এখানে প্রত্যেক সেকেন্ডে প্রায় ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরী হচ্ছে। একিই সাথে তৈরী হচ্ছে বিপুল পরিমান তাপ ও শক্তি। সূর্যের ফিউশন বিক্রিয়া প্রোটন- প্রোটন (P-P) চেইন নামে পরিচিত। এই বিক্রিয়া প্রোটনের (H+) মাধ্যেমে শুরু হয় এবং পর্যায় ক্রমিক বিক্রিয়ার মাধ্যেমে হিলিয়ামে পরিনত হয়। এই বিক্রিয়ার কারণেই টিকে আছে সূর্য সহ গোটা সৌর জগত।
এটি সূর্যের সর্ব অন্তঃস্থ অঞ্চল।কোর এর ব্যাসার্ধ সূর্যের মোট ব্যাসার্ধের ২০-২৫ % হয়ে থাকে।আর আয়তন সূর্যের মোট আয়তনের মাত্র ০.৮% -১.৫%।কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যেই সূর্যের ৩৪% ভর কেন্দ্রীভূত। তাইতো এই অঞ্চলের ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১৫০ গ্রাম, যা পানির ঘনত্বের ১৫ গুন। এটিই সূর্যের সর্বোচ্চ ঘনত্বময় স্থান। ঘনত্ব এত বেশী হওয়া সত্তেও এই অঞ্চলে পদার্থ কঠিন অবস্থায় নেই, আছে প্লাজমা অবস্থায়। কারন প্রতিনিয়ত ফিউশন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হচ্ছে ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রাই সূর্যের কোরের তাপমাত্রা । তবে সূর্যের পৃষ্ঠে পৌছলে এই তাপমাত্রা কমে পাঁচ থেকে ছয় হাজার ডিগ্রী কেলভিনে নেমে আসে এবং যা ছড়িয়ে পড়ে গোটা সৌরজগতে।
বহিঃস্থ কোরের রাসায়নিক গঠনে আছে হাইড্রোজেন ৭৫%, হিলিয়াম ২৪%, আর বাকি ১% হল অক্সিজেন, কার্বন, আয়রন, নিয়ন ।কিন্তু হিলিয়াম হাইড্রোজেনের তুলনায় ভারী বলে অন্তঃস্থ কোরে এদের পরিমাণ বহিঃস্থ কোরের তুলনায় ভিন্ন। অন্তঃস্থ কোরে হাইড্রোজেনের পরিমান মাত্র ৩৩ %। কোরের ভিতরের চাপ পৃথিবী পৃষ্ঠের চাপের প্রায় ১০ লক্ষ গুন। গ্রাভিটির কারনে সূর্যের সমস্ত ভর ইহার কোরে কেন্দ্রীভূত হতে পারে না কারন কেন্দ্রে উৎপন্ন প্রচুর তাপের জন্য উদ্ভুত বহির্মুখী চাপ একে প্রতিহত করে ।
আমরা জানি, হাইড্রোজেন এটম বোমা ফিউশন বিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে তৈরী হয়। কিন্তু সূর্যের কেন্দ্র হাইড্রোজেন বোমার মত বিস্ফোরিত হতে পারে না কারন কেন্দ্রের উপরে অবস্থিত বিকিরন অঞ্চলের বৃহৎ ভর কেন্দ্রের বিধংস্বী প্রবণতাকে সক্ষমতার সাথে প্রতিরোধ করে। এর তাপমাত্রা প্রায় ১.৫ কোটি ডিগ্রী কেলভিনেরও বেশী বলে এই তাপমাত্রায় পরমাণুসমূহ তাদের ইলেক্ট্রনকে ধরে রাখতে পারে না। তাই সূর্যের কেন্দ্র হল মুক্ত ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউক্লিয়াস, নিউট্রনের মিশ্রণ। এ তাপমাত্রায় ২ মাইল দীর্ঘ ও ১ মাইল প্রস্থবিশিষ্ট একটি বরফের ব্লক নিমিষেই গলে যাবে।
কেন্দ্রে দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ নির্গত হয় না বলে এটি অন্ধকার তথা কালো। সূর্যের কেন্দ্র সল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যের গামা রশ্মি উৎপন্ন করে। এই গামা রশ্মিই হলো তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গের ক্ষুদ্রত্তম তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। পরবর্তীতে এই তরঙ্গ কোর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় চার্জিত কনার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং শক্তি হ্রাস পেয়ে পর্যায়ক্রমে এক্সরে, আল্ট্রা ভায়োলেট ও দৃশ্যমান আলোক রশ্মি উৎপন্ন করে।
এভাবে একটি ফোটন কণা তথা তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গের সূর্যের কোর থেকে বাইরের পৃষ্ঠে বেরিয়ে আসতে গড়ে মিলিয়ন বছর সময় লাগে। আমরা আজকে সূর্যের যে আলো পাচ্ছি তা কত পূর্বে সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন হয়েছিলো? সত্যি ভাবনার বিষয়! কোরের অঞ্চলের উজ্জ্বলতা পৃষ্ঠের ১০০ বিলিয়ন গুন। সুতরাং পরিশেষে বলতে হয়, মানুষের উজ্জ্বল চেহারা তথা সৌন্দর্যের পিছনে রক্তের যে অবদান, টকটকে গোলাপের সৌরভে মাটির রসের যে অবদান, তেমনি সূর্যের দীপ্তীময়তা, তেজের পিছনে নীরবে লুকিয়ে আছে সূর্যের কোর তথা কেন্দ্র।
Video credit: 1minutedoc
উৎসঃ উইকিপিডিয়া৷
No comments