ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি
গত দশ এপ্রিল রাতে ঢুঁ মারলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম ফেইসবুকে। চমকে উঠলাম ব্ল্যাক হোলের ছবি দেখে।আনন্দ অনুভব করলাম কারন অদৃশ্য বস্তুটির পর্দা উন্মোচন হল বলে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম স্থির দৃষ্টিতে। বুঝতে বাকি থাকলো না আইস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের মহত্ত্ব। ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না সেই মানুষটিকে। যিনি গানিতিক জটিল তাত্ত্বিক সমীকরণ কোষে বলে দিয়েছেন ব্ল্যাক হোলের অজানা তথ্যসমূহ। ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত, আলোক রিং সবই চোখে পড়ল। যাহোক, আজকে জানব ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবির রহস্য সম্পর্কে।
ব্ল্যাক হোলের এই ছবিটি কোনো ফটোগ্রাফ বা স্থির চিত্র নয় বরং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কতিপয় শক্তিশালী টেলিস্কোপের সম্মিলিত ডেটার সমন্বয়ে তৈরি একটি চিত্র। যা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে অনেক বৈজ্ঞানিক কৌশল ও মডেল। আর এসবের পিছনে প্রধান নিয়ামক টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণকৃত ডেটা।এই কারনে তৈরীকৃত ছবিটি কোনো সিমুলেশন নয়।
আমরা ইতোপূর্বে ব্ল্যাক হোলের যে ছবি দেখে এসেছি সেগুলো বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও গানিতিক মডেলের কম্পিউটার সিমুলেশন মাত্র।
এপ্রিল ২০১৭ থেকে বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপের একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক তৈরী করে ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি তোলার ব্যাপারে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন।প্রথমে তারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে সেজিটারিয়াস এ( Sagittarius A) ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলার কাজটি শুরু করেন।যার ভর সুর্যের ভরের ৪.৩ মিলিয়ন গুন, ব্যাসের ৩০ গুন এবং পৃথিবীর থেকে দূরত্ব প্রায় ২৬,০০০ আলোক বর্ষ। আমাদের দৃশ্যপট থেকে অনেক দূরে। আর এই ব্ল্যাক হোলের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পৃথিবী থেকে দেখা চাঁদে রাখা একটি কমলালেবুর ছবির মত। ফলে বিজ্ঞানীরা সেজিটারিয়াস এ এর তীক্ষ্ণ, স্পষ্ট কোনো ছবি তৈরিতে ব্যর্থ হন। তাই তারা এমন একটি কাছাকাছি ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণের জন্য খুঁজতে থাকেন যার ভর, ব্যাস ও বেতার তরঙ বিকিরণ অনেক বেশী হবে। তারা পৃথিবী থেকে ৫৫ মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরে সূর্যের তুলনায় ৬.৫ বিলিয়ন গুন ভারী এবং সেজিটারিয়াস এ থেকে ২০০০ গুন বড় এম ৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট করেন। যদিওবা এটি সেজিটারিয়াস এ থেকে অনেক দূরে কিন্তু ভর ও ব্যাস অনেক বেশী।
২০১৭ সালের পহেলা এপ্রিল থেকে ৫ এপ্রিল মাত্র পাঁচ দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সমন্বিত টেলিস্কোপ ব্যবস্থা একই সাথে রেডিও তরঙ্গ রেকর্ড করে।
কিন্তু পৃথিবীর আহ্নিক গতি, বায়ুমন্ডলের মেঘ, মহাজাগতিক বিকিরণ, বিশাল দূরত্ব ও এম ৮৭ গ্যালাক্সির ধুলিমেঘের কারণে পর্যবেক্ষণকৃত ডেটায় ডেটা শুন্যতা ( data gap) তৈরী হয়। প্রায় দুই বছর এর ডেটার উপর গানিতিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা চালানো হয়।প্রচলিত গানিতিক এলগরিদম দিয়ে ডেটা শুন্যতা পূরণ করা হয়। কিন্তু প্রচলিত গানিতিক এলগরিদম পর্যাপ্ত ডেটা শুন্যতা পূরন করতে পারে নি। তাই প্রজেক্ট যন্ত্রাংশের সাথে সংগতিপূর্ণ নতুন এলগরিদম মডেল উদ্ভাবন করে প্রচলিত এলগরিদম ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটানো হয়। ড. কেটি বুমেন একজন ২৯ বছর বয়সী এম আই টি স্নাতকধারী কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট।যিনি নতুন এলগরিদম তৈরি করে টেলিস্কোপের টেরাবাইট ডেটা প্রসেসিং করেন এবং ডেটা শুন্যতা দূর করেন। আর নিজেকে ইতিহাসের অংশ করে নেন খুব অল্প বয়সেই।
চিত্রঃ অসম্ভবকে বাস্তবে রুপ দিয়ে হাস্যমুখ ড. কেটি বুমেন ( image source: Facebook page of Katie Bouman)
চিত্রঃ এম ৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্র ( image source: Wikipedia)
সমন্বিত টেলিস্কোপগুলো মাত্র পাঁচ দিনে ৫,০০০ ট্রিলিয়ন বাইট ডেটা সংগ্রহ করে। এই ডেটা ৫০,০০০ বছরের MP3 ফাইলের সমান অথবা ৪০,০০০ মানুষের সারা জীবনের সেল্ফি ডেটার সমান
কিন্তু পৃথিবীর আহ্নিক গতি, বায়ুমন্ডলের মেঘ, মহাজাগতিক বিকিরণ, বিশাল দূরত্ব ও এম ৮৭ গ্যালাক্সির ধুলিমেঘের কারণে পর্যবেক্ষণকৃত ডেটায় ডেটা শুন্যতা ( data gap) তৈরী হয়। প্রায় দুই বছর এর ডেটার উপর গানিতিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা চালানো হয়।প্রচলিত গানিতিক এলগরিদম দিয়ে ডেটা শুন্যতা পূরণ করা হয়। কিন্তু প্রচলিত গানিতিক এলগরিদম পর্যাপ্ত ডেটা শুন্যতা পূরন করতে পারে নি। তাই প্রজেক্ট যন্ত্রাংশের সাথে সংগতিপূর্ণ নতুন এলগরিদম মডেল উদ্ভাবন করে প্রচলিত এলগরিদম ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটানো হয়। ড. কেটি বুমেন একজন ২৯ বছর বয়সী এম আই টি স্নাতকধারী কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট।যিনি নতুন এলগরিদম তৈরি করে টেলিস্কোপের টেরাবাইট ডেটা প্রসেসিং করেন এবং ডেটা শুন্যতা দূর করেন। আর নিজেকে ইতিহাসের অংশ করে নেন খুব অল্প বয়সেই।
চিত্রঃ অসম্ভবকে বাস্তবে রুপ দিয়ে হাস্যমুখ ড. কেটি বুমেন ( image source: Facebook page of Katie Bouman)
সব ডেটা শুন্যতা (data gap) পূরন করে ব্ল্যাক হোলের ইমেজ তৈরী করা হয়। অবশেষে গত ১০ এপ্রিল প্রকাশিত এম৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি অতি ভারী ব্ল্যাক হোলের ছবি বিশ্ববাসীর সামনে আসে। ছবিটি ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের বাস্তব প্রমান।এই ছবির কেন্দ্রে কালো অংশকে ঘিরে আছে একটি আলোর রিং। এই আলোক রিং এর একপাশ বেশ উজ্জ্বল। এই মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সি বা এম৮৭ গ্যালাক্সিটি ভিরগো গ্যালাক্সি ক্লাস্টার নামক গ্যালাক্সিগুচ্ছে অবস্থিত।এর ঘটনা দিগন্তের ব্যাস সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের ১২০ গুন যা প্লুটোর কক্ষপথকেও ছাড়িয়ে যাবে। অবশেষে আমাদের দৃষ্টিগোচরে আসা অসম্ভব মনে করা জিনিসটাও দৃশ্যপটে ধরা দিল।
চিত্রঃ প্রথম ব্ল্যাক হোলের ছবি। ( image source: event horizon telescope collaboration)
ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপ (Event Horizon Telescope- EHT) নামক সম্মিলিত ৮টি টেলিস্কোপ ব্যবস্থা।২০ টি দেশের ৫৯ টি প্রতিষ্ঠানের ২০০ জন গবেষক এক দশকেরও অধিক সময় ধরে কাজ করেছেন।এই প্রজেক্টের নাম- ইভেন্ট হোরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত।
ব্ল্যাক হোলের যে সীমানা পর্যন্ত আলো, বিকিরণ কোনো কিছুই ফিরে আসতে পারে না তাকে ব্ল্যাক হোলের ঘটনাদিগন্ত বলে।
ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলার জন্য বিজ্ঞানীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মোট আটটি টেলিস্কোপকে সমন্বিত করেন।আর এই সমন্বয় করা হয় ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অব্জার্ভেটরিকে অনুসরন করে খুব দীর্ঘ বেসলাইন ইন্টারফেরোমেট্রি( very long baseline interferometry-VLBI)ব্যবহার করে। এখানে ইন্টারফেরোমেট্রি হলো কতগুলো টেলিস্কোপের এমন বিন্যাস যার মাধ্যমে টেলিস্কোপগুলো একটি একক ইউনিট হিসেবে কাজ কাজ করে মহাজাগতিক বস্তুর ( গ্রহ, তারকা, সুপারনোভা,নেবুলা, গ্যালাক্সি ইত্যাদি) খুবই ভালো মানের ছবি তুলতে পারে। আর এই সমন্বয় খুবই কার্যকরীভাবে পৃথিবীর সমান একটি ভার্চুয়াল টেলিস্কোপ তৈরি করে। এই সমন্বয়কে টেলিস্কোপের বৈশ্বিক সমন্বয় বলা যেতে পারে।
চিত্রে এই আটটি টেলিস্কোপকে তাদের অবস্থান সহ দেখানো হয়েছে।
ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবিটি দৃষ্টিগোচরে আসার প্রধান জাদু হলো অনন্য টেলিস্কোপ সমন্বয় ব্যবস্থা।
সমন্বিত টেলিস্কোপগুলো মাত্র পাঁচ দিনে ৫,০০০ ট্রিলিয়ন বাইট ডেটা সংগ্রহ করে। এই ডেটা ৫০,০০০ বছরের MP3 ফাইলের সমান অথবা ৪০,০০০ মানুষের সারা জীবনের সেল্ফি ডেটার সমান।বিজ্ঞানীরা এই ডেটা স্পেক্ট্রো- কম্পিউটার দিয়ে প্রসেসিং করে ইমেজ তৈরী করেন। এ কাজ করতে ২০০ জন গবেষকের ২ বছর সময় লাগে।
টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত নিয়ে ছয়টি সিরিজ পেপার দ্য এস্ট্রোফিসিক্যাল জার্নাল লেটারস (The Astrophysical Journal Papers) এ প্রকাশিত হয়।এসব জার্নালে প্রজেক্টের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
পেপার-২ এ ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপের( ইএইচটি) সমন্বয়, বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে প্রযুক্তির উন্নয়ন, ইন্সট্রুমেন্টেশন, সূক্ষ্ম সনাক্তকরণ ব্যবস্থার সৃষ্টি এবং টেলিস্কোপ সমন্বয়ের মাধ্যমে অনন্য ইমেজিং কৌশল ব্যবস্থা তৈরির ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত নিয়ে ছয়টি সিরিজ পেপার দ্য এস্ট্রোফিসিক্যাল জার্নাল লেটারস (The Astrophysical Journal Papers) এ প্রকাশিত হয়।এসব জার্নালে প্রজেক্টের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
পেপার-২ এ ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপের( ইএইচটি) সমন্বয়, বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে প্রযুক্তির উন্নয়ন, ইন্সট্রুমেন্টেশন, সূক্ষ্ম সনাক্তকরণ ব্যবস্থার সৃষ্টি এবং টেলিস্কোপ সমন্বয়ের মাধ্যমে অনন্য ইমেজিং কৌশল ব্যবস্থা তৈরির ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
পেপার -৩ এ ডেটা সংগ্রহ, ডেটা প্রক্রিয়াকরন, এলগরিদম ক্রমাঙ্কন( calibration),বিশ্লেষণের উপযুক্ত ডেটা বাছাইকরণের জন্য কঠোর বৈধতা নীতির ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
পেপার-৪ এ ইমেজ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া ও পথ( process & approach) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রচলিত ইমেজিং এলগোরিদম ও ইএইচটি যন্ত্র উপযোগী নতুন এলগরিদম কৌশলের কঠোর মূল্যায়ন এবং সাংশ্লেষিক ডেটা সেট বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে ইমেজিং এলগরিদমকে কয়েক মাস ধরে টেস্ট করা হয়েছে। এভাবে ব্ল্যাক হোলের চূড়ান্ত ইমেজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
পেপার-৫ এ জেনারেল রিলেটিভিস্টিক ম্যাগনেটো হাইড্রো ডাইনামিক (জিআরএমএইচডি) সিমুলেশন ও উন্নত রশ্মি চিহ্নিতকারক ব্যবস্থা ব্যবহার করে ইমেজ ও ডেটার বিশ্লেষণ করে ব্ল্যাক হোলটির পরিবৃদ্ধি( accretion) ও প্রচন্ড বেগপূর্ণ বিকিরণের( জেট রেডিয়েশন) ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।।
পেপার-৬ এ মডেল উপযুক্তকরণ, ডেটা দিয়ে করা সিমুলেশনের তুলনা করা হয়েছে।ব্ল্যাক হোলের ইমেজ থেকে আলোক রিং এর আকার- গঠন, ব্ল্যাক হোলের ভর, ব্ল্যাক হোলের প্রকৃতি ও বেষ্টনকারী স্থান কালের উপরে বিরাজমান প্রভাবকের তথ্য বের করা হয়েছে।
পেপার-১ এ পেপার ২-৬ এর সারমর্ম বর্ণনা করা হয়েছে।
সুতরাং ব্ল্যাক হোলের ছবিটি মাত্র কয়েক কিলো বাইট কিন্তু এটি সংশ্লেষণ করা হয়েছে কয়েক হাজার টেরাবাইট ডেটা থেকে।
উৎসঃ আই ও পি সায়েন্স ডট ওআরজি, সিএনএন, স্পেস ডট কম, ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপ ডট ওআরজি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডট কম , সায়েন্স নিউজ ফর স্টুডেন্টস ডট ওআরজি ।।
No comments