বয়স নির্ণয়ে কার্বন ডেটিং পদ্ধতি ও সীমাবদ্ধতা


উদ্ভিদ প্রাণি উভয়ের অপরিহার্য উপাদান হল কার্বন। প্রোটিনের প্রায় অর্ধেক ভাগ আর সেলুলোজের শতকরা প্রায় চুয়াল্লিশ ভাগই কার্বন দিয়ে গঠিত। কার্বন জীবে জটিল অংশ হিসেবে থাকে। কার্বনের বেশির ভাগ অংশই স্থায়ী তবে অল্প কিছু অংশ অস্থায়ী তথা তেজস্ক্রিয়। কোনো জৈব বস্তুতে এই তেজস্ক্রিয় কার্বনের পরিমান হিসাব করে তার বয়স নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় কার্বন ডেটিং সংক্ষেপে শুধু কার্বন ডেটিং। তাহলে জানা দরকার কিভাবে এই পদ্ধতি কাজ করে।                                                   
কার্বন-১৪
কার্বনের জমজ ভাই সম্পর্কে অনেকেই জানে না। সূর্য থেকে আসা উচ্চ শক্তির মহাজাগতিক রশ্মি অনবরত আমাদের গ্রহে আছড়ে পড়ছে। নিউট্রন সমৃদ্ধ এমন রশ্মি বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তৈরী করে কার্বন-১৪ বা সি-১৪ ,যা কার্বন-১২ এর একটি আইসোটপ।

একটি পরমানু তার আইসোটপ এর ইলেক্ট্রিক ধর্ম একই কিন্তু ভৌত ধর্ম ভিন্ন। কারন উভয় পরমানুর ইলেক্ট্রন প্রোটন সংখ্যা একই হলেও নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন। কার্বন-১৪ এর বিশেষ ধর্ম হলো অস্থায়িতা বা তেজস্ক্রিয়তা। এ জন্য কার্বন বিভিন্ন কণা বিকিরিত করে ক্ষয় হয়।
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মূলনীতি   
তেজস্ক্রিয় কার্বন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরী করে। এই তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাইঅক্সাইড উদ্ভিত কর্তৃক গৃহীত হয় এবং যা পরবর্তীতে তৃণভোজী প্রাণিতে সঞ্চারিত হয়। এই তৃণভোজী প্রাণি মাংসাশী অথবা সর্বভূক প্রাণিতে গৃহীত কার্বনকে সঞ্চারিত করে। বায়ুমন্ডলের প্রত্যেক জীবের গ্রত্থিত কার্বনের অধিকাংশই কার্বন-১২, সামান্য অংশ কার্বন-১৪। একটি প্রাণি কার্বন গ্রহন করে আবার শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে একে নির্গত করে। কার্বন-১৪ পরমানুর উৎপাদন, গ্রহন এবং ত্যাগ এমন ভাবে ঘটে যেন পরিবেশ বা প্রানীতে  কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর অনুপাত সর্বদা একই থাকে।( এমনকি যদিও  পরিবেশ জীব থেকে জীবে কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর পরিমান ভিন্ন হয়। ) সুতরাং


কার্বন ডেটিং এর মূল উপপাদ্য বিষয় হলোঃ কার্বনের চক্রাকার লেনদেন সত্তেও একটি জীবন্ত সত্তায় পরিবেশের মতই কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর অনুপাত সর্বদা একই থাকবে

চিত্রঃ কার্বন-১৪ পরমাণুর বিনিময়। (image source: scienceabc.com)


যখন একটি জীব মৃত্যুবরন করে ,আর কার্বন গ্রহন করতে পারে না। তখন কার্বন-১৪ তেজস্ক্রিয় হওয়ায় ক্ষয় হতে শুরু করে কিন্তু কার্বন-১২ এর ক্ষয় হয় না। তাই কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর অনুপাত পর্যায়ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। সময় যত যেতে থাকে অনুপাত ততই কমতে থাকে। আর এই অনুপাত প্রত্নতাত্ত্বিকদের বয়স নির্ধারনে সাহায্য করে।  
নিচের সমীকরন ব্যবহার করে খুব সহজে বয়সের হিসেবটি করা হয়।
https://www.scienceabc.com/wp-content/uploads/ext-latex.codecogs.com/gif.latex-largeampspaceNN%5Ecirce%5E-lambdaampspacet.latex--------------------------()
এই সমীকরনটি তেজস্ক্রিয় আইসোটপের ক্ষয় নির্দেশ করে। এখানে, N0 = মৃত্যুর সময় জীবে উপস্থিত তেজস্ক্রিয় আইসোটপের সংখ্যা বা ( t=0) প্রাথমিক পরমানুর সংখ্যা। N= বর্তমানে বা ক্ষয় হওয়ার পরে অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয় আইসোটপের সংখ্যা। N এর পরিমান বের করা অনেক সহজ। বিটা কাউন্টার বা মাস এক্সিলারেটর স্পেক্ট্রোমিটার ব্যবহার করে নমুনাতে উপস্থিত তেজস্ক্রিয় আইসোটপের সংখ্যা সহজে বের করা যায়। λ  হল ক্ষয় ধ্রুবক কার্বন-১৪ জন্য λ  এর
মান ৮২৬৭। আর t হল বয়স বা অতিবাহিত সময়
এখন আলোচনা করা যাক, N0 কিভাবে নির্ণয় করা যায়। আমরা পূর্বেই জেনেছি, প্রত্যেক জীবের জন্য সবসময় পরিবেশে কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর অনুপাত একই থাকে। এই অনুপাতকে আমরা x ধরে নেই। এই অনুপাতের মান জানা।
X= কার্বন-১৪ এর সংখ্যা/ কার্বন-১২ এর সংখ্যা  
এখানে কার্বন-১৪ এর সংখ্যা মানে  N0   আর নমুনা জীবে কার্বন-১২ এর সংখ্যা বিটা কাউন্টার বা মাস এক্সিলারেটর স্পেক্ট্রোমিটার ব্যবহার করে নির্ণয় করা যায়। তাহলে এই সমীকরন থেকে সহজেই N0  এর মান বের করা যাবে।
সমীকরন - কে পূণর্বিন্যাস করলে আমরা t এর মান পেয়ে যাব

https://www.scienceabc.com/wp-content/uploads/ext-latex.codecogs.com/gif.latex-largeampspacelargeampspacet8267cdotampspacelog_eN%5EcircNyears.latex
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির গ্রহনযোগ্যতা  


এই পদ্ধতির মূলনীতি ত্রুটি যুক্ত এর মূলনীতি শুধুমাত্র একটি অনুমান , সত্য নয়। পরিবেশে কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর অনুপাত সর্বদা একই থাকে না


image source: Wikimedia commons

কিছু মৌলিক ত্রুটির কারনে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির গ্রহনযোগ্যতা কমে গেছে। এই পদ্ধতির মূলনীতি ত্রুটি যুক্ত এর মূলনীতি শুধুমাত্র একটি অনুমান , সত্য নয়। পরিবেশে কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর অনুপাত সর্বদা একই থাকে না। কারনঃ
১। শিল্পবিপ্লবঃ শিল্প টিকেই আছে জীবন্ত জীবাশ্ম ( কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল) কে ব্যবহার করে। এসব পুড়িয়ে প্রচুর পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড কার্বন-১২ থেকে তৈরী হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে যাচ্ছে। এতে কার্বন-১২ এর পরিমান বায়ুমন্ডলে বেড়ে গিয়ে কার্বন-১৪ কার্বন-১২ এর অনুপাত কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির ব্যবহারে কোন নমুনার বয়স বাস্তবিকের চেয়ে বেশী হয়ে যাবে।  
২।নিউক্লিয়ার মরনাস্ত্রঃ অপরদিকে প্রচুর পরিমান নিউক্লিয়ার মরনাস্ত্র পরীক্ষার কারনে বায়ুমন্ডলে তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ এর পরিমান ভয়ঙ্কর হারে বেড়েই চলছে। ফলে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির ব্যবহারে কোন নমুনার বয়স বাস্তবিকের চেয়ে কম হয়ে যাবে।
   
চিত্রঃ অনিয়ন্ত্রিত কার্বন -১২ নিঃসরণ। ( image source: sciscienceabc.com)
বর্তমানে, বর্ধিত বা হ্রাসকৃত কার্বন-১৪ পরমানুর বিচ্যুতির জ্ঞানকে ব্যবহার করে নির্ণীত আপাত মান থেকে ভুলের পরিমান যোগ বা বিয়োগ করে কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নমুনার প্রকৃত বয়স পাওয়া যেতে পারে।
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
সমীকরন- ক্ষয় ধ্রুবক λ  পাওয়া যায় কোনো তেজস্ক্রিয় আইসোটপের অর্ধায়ু (কোনো তেজস্ক্রিয় আইসোটপের মুল অংশ থেকে অর্ধেক ক্ষয় হতে অতিবাহিত সময়) থেকে। কার্বন-১৪ পরমানুর অর্ধায়ুর মান ,৩৭০ বছর। অতএব, এক-চতুর্থাংশ এক-অষ্টমাংশ হতে সময় লাগবে যথাক্রমে ১০,৭৪০ ১৬,১১০ বছর। এভাবে কমতে কমতে ৫০,০০০ বছর পরে কার্বন-১৪ এর পরিমান নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায় বা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না।
তাই বলা যায়,পদ্ধতি কার্বন ডেটিং প্রশ্নের উর্ধে নয়। এর মাঝে মৌলিক ত্রুটি সহ কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ্যণীয়।  

উৎসঃ সায়েন্স এবিসি ডট কম, উইকিপিডিয়া

No comments

Theme images by JacobH. Powered by Blogger.