সূর্যের কেন্দ্র থেকে আসা এক বিন্দু আলোর গতিপথ
বসন্ত শেষে প্রকৃতি গ্রীষ্মের নতুন আমেজে আমাদের রঙ্গিয়ে তুলেছে। শুরু হয়েছে প্রচন্ড উত্তাপ। দুপুরে ঘরের বাইরে বের হওয়া কষ্টকর। সূর্য যেন আগের চেয়ে অনেক তেজ দীপ্ত। বিজ্ঞানীদের মতে, সূর্যের প্রতি এগারো বছরে সক্রিয়তার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। একে বলা হয় সৌর চক্র বা সোলার সাইকেল। হয়তবা সূর্যের প্রতি বছর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাহোক, এই উত্তাপের জন্য পৃথিবীতে আমাদের অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থানও অনেকাংশে দায়ী। কখনও চিন্তা করেছি সূর্য থেকে এত তাপ ও আলো কিভাবে আসে?
নিশ্চয়ই নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার নাম জেনে থাকবেন। এই বিক্রিয়া সূর্যের কেন্দ্রে সংঘটিত হচ্ছে অবিরামভাবে এবং উৎপন্ন করছে ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রা ও বিপুল শক্তি। মানুষের বেঁচে থাকতে যেমন হার্টের কার্যকারিতা প্রয়োজন, তেমনি সূর্যের তেজ বা জীবন এই ফিউশন বিক্রিয়া নির্ভর।সূর্য গাঠনিকভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত যেমন : কেন্দ্রীয় অঞ্চল, বিকিরণ অঞ্চল, পরিচলন অঞ্চল ইত্যাদি। এসব অঞ্চলের মধ্যে সূর্যের জ্বালানি উৎপাদনক্ষম অঞ্চলের নাম কেন্দ্রীয় অঞ্চল।আর বাকি অঞ্চল সমূহ কেন্দ্রে উৎপন্ন ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপকে বাইরে ছড়িয়ে দেয়।
সূর্যের কেন্দ্রে প্রতিনিয়ত ৩৮০ বিলিয়ন বিলিয়ন মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। আর এটা কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে চলছে। প্রতি সেকেন্ডে ৫৬৪ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন থেকে ৫৬০ মিলিয়ন টন হিলিয়াম তৈরী হচ্ছে। আর বাকি চার মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন থেকে উল্লেখিত শক্তি তৈরী হচ্ছে। ফিউশন বিক্রিয়ায় সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন এই শক্তি সূর্যের বহিরাংশের দিকে ফোটন তথা তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ হিসেবে আলোক কনা ও তাপ দ্বারা বাহিত এবং সৌর পৃষ্ঠ থেকে সৌর জগতে ছড়িয়ে পড়ে।
সূর্যের কেন্দ্রের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের ১৫ গুন বেশী। আবার সূর্যের বিষুবীয় অঞ্চল বরাবর মোট ব্যাসার্ধ ৬,৯৫,৭০০ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর মোট ব্যাসার্ধের ১০৯ গুন। সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন তাপ ও আলোকে এই বিশাল অঞ্চল পাড়ি দিতে হয়। যদিও সূর্যের কেন্দ্র থেকে বাইরের অঞ্চলের দিকে ঘনত্ব পর্যায়ক্রমে হ্রাস পায়,তবুও কেন্দ্রে উৎপন্ন তাপ ও আলোকে এই বিশাল অঞ্চল পাড়ি দিতে অনেক সময় লাগে। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, বিকিরণ অঞ্চলকে পাড়ি দিতে একটি গামা রশ্মির তথা ফোটন কণার গড়ে ১,৭১,০০০ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ বছর সময় লাগে এবং সৌর পৃষ্ঠ হতে পৃথিবীতে আসতে লাগে মাত্র সোয়া আট মিনিট । সুতরাং চিন্তা করতেও অবাক লাগে, আমরা পৃথিবীতে বসে আজকে যে আলো পাচ্ছি তা কত লক্ষ বছর পূর্বে সূর্যের কেন্দ্রের ফিউশন বিক্রিয়ার ফল? একারনেই বলতে হয়, আমরা মহাবিশ্বের দিকে তাকালে শুধু অতীতকেই দেখতে পাই। আমরা আজ আলোচনা করব কিভাবে তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ এই বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ছে।
"চিন্তা করতেও অবাক লাগে, আমরা পৃথিবীতে বসে আজকে যে আলো পাচ্ছি তা কত লক্ষ বছর পূর্বে সূর্যের কেন্দ্রের ফিউশন বিক্রিয়ার ফল"
সূর্যের কেন্দ্রকে ঘিরে রাখা প্লাজমার ( ইলেক্ট্রন ও আয়নের মিশ্রণ) ঘনত্ব অনেক বেশী। তাইতো ফিউশন বিক্রিয়ায় নির্গত গামা রশ্মি( ফোটনের সর্বনিম্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য) খুব কম দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার পূর্বে ইলেক্ট্রন দ্বারা শুষিত হয়। এই ইলেক্ট্রন সমূহ শোষিত ফোটনকে সকল দিকে পুনরায় নির্গমন করে, কিন্তু এই ঘটনায় কিছু পরিমান শক্তি খোয়া যায়। পরবর্তীতে এই ফোটন সমূহ বিকিরণ অঞ্চলে প্রবেশ করে।
বিকিরণ অঞ্চল সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের জন্য অন্তরকের আবরণ হিসেবে কাজ করে, যাতে ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপ ধরে রেখে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটার পরিবেশ তৈরী হয়। এই অঞ্চল পাড়ি দিতে একটি ফোটন অসংখ্য বার ইলেক্ট্রন কর্তৃক শোষিত ও নির্গত হয়, ফলে নেট শক্তি প্রবাহের গতি ধীর হয়ে যায় এবং শক্তির পরিমান কমে যায়। ফলে গামা রশ্মি থেকে এক্সরে তে পরিণত হয়।
চিত্র : সূর্যের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল সমূহ
কেন্দ্রে উৎপন্ন তাপ ও আলোক শক্তি তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ তথা ফোটন ( প্রধানত এক্সরে) হিসেবে বিকিরণ, তাপীয় পরিবহন প্রক্রিয়ায় বিকিরণ অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ অঞ্চলের ঘনত্ব ও তাপমাত্রা কেন্দ্র থেকে কম কিন্তু পরবর্তী অঞ্চল থেকে বেশী।
কেন্দ্রে উৎপন্ন এক্সরে বাবল তৈরী করে কম তাপমাত্রা, ঘনত্ব, চাপের পথ অনুসরণ করেন সূর্য পৃষ্ঠের দিকে ধাবিত হয়। হাইড্রোজেন, হিলয়াম, অসম্পৃক্ত ইলেক্ট্রন দ্বারা বিকিরণ অঞ্চল পূর্ণ থাকে। এ অঞ্চলের গভীরে, এক্সরে বিভিন্ন কনার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বারবার সংঘর্ষের ফলে এক্সরের দিক বারবার পরিবর্তন হয়। দুটি ধাক্কার মধ্যে এক্স রে মাত্র কয়েক মিলিমিটার পথ অতিক্রম করে। এভাবে ধাক্কার পর ধাক্কা খেয়ে এক্সরে সৌর পৃষ্ঠের দিকে গমন করে। তাই ফোটন তথা এক্সরের এই অঞ্চল পাড়ি দিতে ১৭১,০০০ থেকে ১ মিলিয়ন বছর সময় লাগে। ধাক্কার দরুন এক্সরের শক্তি প্লাজমা অনু কর্তৃক শোষিত হওয়ায় এক্সরে এর শক্তি কমে যায় কিন্তু তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে এবং পৃষ্ঠে এসে দৃশ্যমান আলোয় পরিনত হয়। একই সাথে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন থেকে ১.৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিনে হ্রাস পায়।বিকিরণ অঞ্চলকে বেষ্টন কারী পরবর্তী পরিচলন অঞ্চলের ব্যাসার্ধ সূর্যের মোট ব্যাসার্ধের প্রায় ৩০% হয়ে থাকে । এটি সূর্যের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলসমূহের মধ্যে সর্ববহিঃস্থস্তর। এর তাপমাত্রা ও ঘনত্ব বিকিরণ অঞ্চল থেকে কম।
প্রথমত, এ আবরণের নিন্ম প্রান্তে অবস্থিত গ্যাসীয় অনুসমুহ বিকিরণ অঞ্চল থেকে বিকিরিত তাপ গ্রহণ করে। ফলে অনুসমুহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এরা প্রসারিত হয়ে বেলুনের তথা বাবলের মত ফুলে যায়। ফলে এদের ঘনত্ব কমে যায়। তখন তারা পরিচলন অঞ্চলের উপরে অংশে তুলনামূলক কম তাপমাত্রার দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করে। যখন এই উত্তপ্ত গ্যাসীয় অনুসমুহ পরিচলন অঞ্চলের বহির্ভাগে পৌঁছায়, তখন এরা তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়। ফলে তাদের আয়তন কমে গিয়ে ঘনত্ব বেড়ে যায়। এরা আবার পরিচলন অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে আসে এবং পূর্ববর্তী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।
এর তাপ পরিবহন দৃশ্য অনেকটা পানির স্ফুটন দৃশ্যের মত, যেখানে বুদবুদ ( bubble) তৈরী হয়। বাবল তৈরীর এ প্রক্রিয়াকে গ্রানুলেশন বলা হয়। এখানে তাপ স্থানান্তর প্রক্রিয়া এতই দ্রুত যে, এক গুচ্ছ ফোটনের এ অঞ্চল পাড়ি দিতে মাত্র এক সপ্তাহ থেকে তিন মাস সময় লাগে।
চিত্র : সূর্যের পরিচলন অঞ্চল দিয়ে তাপের পরিবহন
আমরা জানি তড়িচ্চুম্বক বর্ণালীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গ হলো গামা রশ্মির।তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট বলে গামা রশ্মির শক্তি অনেক বেশী। সূর্যের কেন্দ্র থেকে এই রশ্মি বিভিন্ন অঞ্চল অতিক্রম করে দৃশ্যমান আলোতে পরিনত হয়। আমরা সূর্যের দিকে তাকালে সূর্যে আলোক মন্ডল নামক অঞ্চল টি দেখতে পাই, কারন তা দৃশ্যমান আলো বিকিরণ করে।গামা রশ্মি বিভিন্ন কনার সাথে ধাক্কা খেয়ে কিংবা ইলেক্ট্রন কর্তৃক শোষিত হয়ে শক্তি হারিয়ে ফেলে। শক্তি হারানোর ফলে ফোটনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। তাইতো দৃশ্যমান আলো সূর্য থেকে পাওয়া যায়। এভাবেই সূর্য থেকে তড়িচ্চুম্বক বর্ণালীর ক্ষুদ্র বর্ণালী থেকে বহৎ বর্ণালী পাওয়া যায়।
Vedio credit:SpaceRip
ইউনিভার্স টুডে ।
No comments